কোরআন ও হাদিসের আলোকে যিকিরের বর্ণনাঃ

 

যিকিরের তিন তরিকাঃ

১) যিকরে জলি

২) যিকরে খফি

৩) যিকরে কলবি

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে যিকিরের শুধু নির্দেশই নাযিল করেননি, তার তরিকা বা নিয়ম-পদ্ধতিও নাযিল করেছেন। যাতে তাঁর বান্দারা নিজেদের মনগড়া তরিকায় যিকির করে গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হয়ে না যায়। যিকিরের তরিকা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে তিনটি আয়াত পাওয়া যায়। যথা-


প্রথম
আয়াতঃ

{وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُةِ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ } [الأعراف: ۲۰۵]

অর্থঃ আর তুমি তোমার রবের যিকির করো আপন মনে ক্রন্দনরত ও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় এবং এমন আওয়াজে যা চীৎকার করে বলা অপেক্ষা কম, সকালে ও সন্ধ্যায়। আর বে-খবর থেকো না।

ক. এই আয়াতের فِي نَفْسِكَ )আপন মনে) দ্বারা যিকরে কলবীর তরিকা জানা গেলো। অর্থাৎ জিহ্বা না নেড়ে শুধু মনে মনে নীরবে আল্লাহর যিকির করা, তাঁর যাত (সত্তা) ও সিফাত (গুণাবলী) সম্পর্কে ধ্যান করা, পবিত্র কুরআনের কোনো আয়াত নিয়ে ধ্যান করা ইত্যাদি।

এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যখন এই তরিকায় তথা জিহ্বা না নেড়ে শুধু ধ্যান বা চিন্তা-ফিকির করে তার যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন এই কলবী যিকিরে অবশ্যই সওয়াব আছে, বিশ্বাস রাখতে হবে। তবে এই কলবী যিকির দ্বারা সালাতের যিকির আদায় হবে না।

খ. (وَدُونَ الْجَهْرِ ) চিৎকার নয়, বরং মৃদু আওয়াজে) দ্বারা যিকরে জলীর তরিকা জানা গেলো। পরবর্তী দ্বিতীয় আয়াতটি জিকরে জলীর আরেকটি দলীল।

 

দ্বিতীয় আয়াতঃ

وَلَا تَجْهَرُ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا} [الإسراء: ١١٠]

অর্থ : আর তুমি তোমার সালাতে (কুরআন তিলাওয়াত তথা আল্লাহর যিকিরে) উচ্চ আওয়াজ দিবে না এবং একেবারে মনে মনেও পড়বে না। বরং এ দুয়ের মাঝামাঝি আওয়াজ অবলম্বন করবে।

সুনানে আবু দাউদে সহিহ সনদসূত্রে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা.  ও উমার রা. কে সালাতের কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে এ হিদায়াতই দিয়েছেন। আবু বকর রা. শব্দহীনভাবে আর উমার রা. উচ্চ স্বরে তাহাজ্জুদের সালাতে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। ফজরের সালাতের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়কে সম্বোধন করে বলেন, আবু বকর কিছুটা জোরে আর উমর কিছুটা আস্তে তিলাওয়াত করবে।

আপনারা হয়তো বলবেন, এই দ্বিতীয় আয়াতে তো সালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, যিকির সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে এটা যিকিরের তরিকা হয় কী করে? জওয়াবে বলবো, কুরআন ও হাদীসের অনেক স্থানে সালাতকে যিকির বলা হয়েছে। যেমন { وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي }  অর্থ : সালাত কায়েম করো। কেননা সালাত আমার যিকির।

 

তৃতীয় আয়াতঃ

ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ} [الأعراف: ۵۵]

অর্থঃ তোমরা তোমাদের রবকে ডাকো (দুআ করো) ক্রন্দনরত অবস্থায় এবং গোপনে। নিশ্চয়ই তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।

এই আয়াত থেকে যিকরে খফীর তরিকা জানা গেলো। অর্থাৎ জিহ্বা নেড়ে কিন্তু আওয়াজ হবে না।

উপরের এই তিনটি আয়াতের ওপর চিন্তা করলে আমরা যিকিরের তরিকা বা পদ্ধতির এই তিনটির নির্দেশ পাই।

প্রথম আয়াতে فِي نَفْسِك ) দ্বারা আপন মনে কলবী জিকরের তরিকা।

আর وَدُونَ الْجَهْرِ ) দ্বারা চিৎকার করে নয়, যিকরে জলীর তরিকা।

দ্বিতীয় আয়াতের وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ এ চিৎকার করো না এবং একেবারে গোপনে করো না বরং এই দুয়ের মাঝামাঝি আওয়াজ অবলম্বন করো-সহ তৃতীয় আয়াতের সমন্বয়ে জিকরে খফীর তরিকা জানতে পারি।

এ ছাড়া একটি হাদীস থেকে জিকরে জলী তথা মৃদু স্বরে যিকিরের তরিকার কথা জানতে পারি। হাদীসটি হচ্ছে…

عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَكُنَّا إِذَا أَشْرَفْنَا عَلَى وَادٍ، هَلَّلْنَا وَكَبَّرْنَا ارْتَفَعَتْ أَصْوَاتُنَا، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ، فَإِنَّكُمْ لَا تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلَا غَائِبًا، إِنَّهُ مَعَكُمْ إِنَّهُ سَمِيعٌ قَرِيبٌ، تَبَارَكَ اسْمُهُ وَتَعَالَى جَدُّهُ

অর্থ : আবু মূসা আশআরী রা. বলেন, আমরা এক সফরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গী ছিলাম। লোকেরা জোরে জোরে তাকবীর দিচ্ছিলো। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোকেরা, তোমরা নিজেদের ওপর নরম বা দয়ালু হও। তোমরা কোনো বধির বা অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছো না। তোমরা যাকে ডাকছো, তিনি শ্রবণকারী ও দৃষ্টি দানকারী। তিনি তো তোমাদের সঙ্গেই আছেন।

সুতরাং তিন প্রকারের জিকির,

এক.       জিকরে জলি

দুই.        জিকরে খফি

তিন.      জিকরে কলবি

এইসব প্রকারের জিকির জায়েজ। বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিইঃ

* কোরআনের তেলাওয়াত জোরে করা কুরআন দ্বারা সাব্যস্ত। আবার কোরআন তেলাওয়াত আস্তে করাও জায়েজ।

নামাজে কোরআন তেলাওয়াত  যেমন জোরে পড়া হয় আসতেও পড়া হয়।  আর নিঃসন্দেহে কোরআন তেলাওয়াত ও একটা জিকির।

প্রকাশ থাকে যে অনেক আউলিয়ায়ে কেরাম মাশায়েকে কেরাম, পীর মাসায়েকগণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে  জিকির করিয়ে থাকেন সেটি তালিমের জন্য।

যেমন নাকি তালিমের জন্য তেলাওয়াত কেও ভেঙ্গে ভেঙ্গে জোরে জোরে করা যায়।

আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলা আমাদেরকে আল্লাহর জিকিরের উপর বেশি থেকে বেশি আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখকঃ

মুফতি শাহাদাত হোসাইন জাফরী

প্রিন্সিপাল,

মধুপুর  জামিয়াতুল মারিফ আল ইসলামিয়া।

নোয়াখালী